অক্ষয় পাত্রের কাহিনী। শ্রী কৃষ্ণের কৃপায় পান্ডবদের বিপন্মুক্তি - Probaho Bangla

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫

অক্ষয় পাত্রের কাহিনী। শ্রী কৃষ্ণের কৃপায় পান্ডবদের বিপন্মুক্তি

Story of Akshay Patra, a mythical vessel with an endless supply of food.

জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির তাঁর ন্যায়পরায়ণতা ও সততার জন্য বিশ্ববিখ্যাত। তিনি ধর্মরাজ নামে পরিচিত। তাকে বলা হয় ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। তিনি সত্য ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক। তাঁর জন্মপরিচয়ও উল্লেখযোগ্য–তিনি ধর্মদেবতা যম এবং মাতা কুন্তীর পুত্র। তিনি স্থাপত্যের দেবতা বিশ্বকর্মার দ্বারা নির্মিত সুবিশাল ইন্দ্রপ্রস্থ নগরে রাজত্ব করতেন। তবে সেখানে যুধিষ্ঠির একা থাকেন না। তাঁর চার ভাই রয়েছে।পরাক্রমশালী ভীম, অপ্রতিদ্বন্দ্বী তীরন্দাজ অর্জুন, যমজ ভ্রাতৃদ্বয় নকুল ও সহদেব এবং তাঁর  দুই স্ত্রী-বিদুষী দ্রৌপদী এবং দেবিকা।


যুধিষ্ঠিরের ধর্মের প্রতি অটল নিষ্ঠার সুযোগ নেন ধূর্ত দুর্যোধনের কৌশলী মামা শকুনি। তিনি জানতেন যুধিষ্ঠির কখনো কারোর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন না। তাই শকুনির কুপরামর্শে দুর্যোধন তাঁকে পাশা খেলার আমন্ত্রণ জানিয়ে হস্তিনাপুরে নিয়ে আসেন। যুধিষ্ঠির খেলার প্রস্তাব গ্রহণ করেন, যদিও তিনি জুয়া খেলায় অভিজ্ঞ ছিলেন না। শকুনির চাতুরীর সাহায্যে পাশা খেলায় দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে প্রতারণা করেন। অত:পর বাজি রেখে যুধিষ্ঠির সবকিছু হারিয়ে বসেন-জমি, রাজ্য, ভাই, এমনকি স্ত্রী দ্রৌপদীকেও। এর ফলে, পাণ্ডবরা তেরো বছরের জন্য বনবাসে যেতে বাধ্য হন এর মধ্যে প্রথম বারো বছর ছিল বনবাস ও শেষ এক বছর ছিল অজ্ঞাতবাস।


মহান ঋষিরা, যাঁদের আশীর্বাদে একসময় ইন্দ্রপ্রস্থের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল, তাঁরা ধর্মনিষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভারাক্রান্ত হ্রদয়ে বিদায় জানান। নির্বাসনে গিয়ে অর্থ ও আহারের সীমিত সংস্থান থাকার কারণে যুধিষ্ঠির নতুন সমস্যার সম্মুখীন হন। এমতাবস্থায় তাঁর পরিবারের সদস্যদের দৈনন্দিন জীবন নির্বাহ করাই দুরূহ হয়ে ওঠে।


এই কঠিন সময়ে, যুধিষ্ঠির সূর্য দেবতার নিকট আন্তরিক প্রার্থনা জানান। তাঁর ভক্তিতে খুশী হয়ে সূর্য দেবতা তাঁকে দর্শন দেন ও বরস্বরূপ একটি 'অক্ষয় পাত্র' দান করেন। এটি এমন এক আশ্চর্য পাত্র যা কিনা শেষ ব্যক্তিটির ক্ষুধা নিবৃত্ত না হওয়া পর্যন্ত কখনোই খালি হয় না। এই পাত্রটির সাহায্যে যুধিষ্ঠির ও তাঁর পরিবারের খাদ্যের আর কোন অভাব থাকে রইল না। এমনকি তাঁদের পর্ণকুটিরে আগত অতিথিদেরও সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হন তাঁরা। বৃকোদর (নেকড়ের ন্যায় উদর) ভীম সেনেরও উদরপূর্তির কোন সমস্যা রইল না। এ হেন আতিথেয়তার বার্তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এবং বিভিন্ন স্থান থেকে ঋষিরা আসতে শুরু করেন পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করতে এবং তাঁদের খাদ্য-প্রাচুর্য প্রত্যক্ষ করেন ও যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে তা গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হন।


ওদিকে হস্তিনাপুরে দুর্যোধন হিংসার জ্বালায় জ্বলতে থাকেন। পাণ্ডবদের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার পরও বনবাসে গিয়েও তাঁরা সুখে-স্বাচ্ছন্দে বেঁচে আছেন! অক্ষয় পাত্রের খবর শুনে ঈর্ষাকাতর দুর্যোধন রাগে ফেটে পড়েন এবং দুর্বাসা মুনিকে কেন্দ্র করে আরেকটি ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করেন। প্রচণ্ড ক্রোধ এবং ভয়ঙ্কর অভিশাপ দেওয়ার কারণে পরিচিত দুর্বাসা মুনিকে নিয়ে প্রায় সকলেই ভীত। চালাক ও ধূর্ত দুর্যোধন নানাপ্রকার ছলবলে দুর্বাসা মুনিকে সন্তুষ্ট করেন এবং পাণ্ডবদের আশ্রমে গিয়ে ভোজনের পরামর্শ দেন। বিশেষ করে এটাও জানান যাতে দ্রৌপদীর আহারান্তেই যেন দুর্বাসা মুনি পাণ্ডবদের কুটিরে গিয়ে হাজির হন। চক্রান্তকারী ধূর্ত দুর্যোধন এই ব্যাপারে জ্ঞাত ছিলেন যে দ্রৌপদীর ভোজন সমাপ্ত হলেই অক্ষয় পাত্র খালি হয়ে যাবে।


একদিন সন্ধ্যায় দ্রৌপদী ভোজন সমাপ্ত করে অক্ষয় পাত্র পরিষ্কার করছিলেন। ঠিক সেই সময় দুর্বাসা মুনি ও তাঁর শিষ্যেরা আশ্রমের দিকে অগ্রসর হন। পাত্র খালি থাকায় দ্রৌপদী খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। 


যুধিষ্ঠির দুর্বাসাকে স্বাগত জানান ও তাঁদের স্নানের পর আহারের প্রতিশ্রুতি দেন। সহদেব দ্রৌপদীকে খবর দিতে গিয়ে দেখেন তিনি গভীর প্রার্থনায় নিমগ্ন। দ্রৌপদী চোখে জল নিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করছেন। সহসা এক দিব্য আলোকময় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে শ্রীকৃষ্ণরূপে। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত হন এবং বলেন, "হে সখি, আমাকে কিছু খেতে দাও, আমি খুব ক্ষুধার্ত!" দ্রৌপদী লজ্জা ও দুঃখে বলেন, "প্রভু, পাত্রে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমি নিজেই আহার করে ফেলেছি।" শূন্য অক্ষয় পাত্রের সমস্যার কথা জানান দ্রৌপদী। নাছোড়বান্দা কৃষ্ণ বারবার তাঁকে পাত্রটি দেখানোর জন্য জোর করতে থাকেন। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, "তবুও পাত্রটি আমায় দাও। "সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি পাত্রের নীচে আটকে থাকা একটি ভাতের দানা খুঁজে পান । খপ্ করে সেই ভাতের দানাটি নিজের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ চপল হাসি হেসে কৃষ্ণ জানান যে এমন সুস্বাদু খাবার নাকি তিনি ইতিপূর্বে কখনই আস্বাদন করেননি তিনি সেটুকু খেয়ে বললেন, "আমি তৃপ্ত। এখন সমগ্র বিশ্বও তৃপ্ত।


ওদিকে দুর্বাসা ও তাঁর শিষ্যেরা স্নান করে উঠে হঠাৎই নিজেদের উদর পূর্ণ অনুভব করেন। শ্রীকৃষ্ণের ঐ অলৌকিক শক্তির ফলে দুর্বাসা মুনি ও তাঁর শিষ্যরা এমন এক গভীর তৃপ্তি অনুভব করেন যে, আর এক মুঠো খাদ্য গ্রহণের ক্ষমতাও নেই বলে বোধ হয় তাঁদের। এরপর তাঁরা আর খেতে চাইলেন না। লজ্জায় ভয়ে তাঁরা পান্ডবদের কাছে না গিয়েই চলে যান। আঁধার ঘনিয়ে আসার সুযোগে তাঁরা উধাও হন। নদীর ধারে খুঁজতে গিয়েও অতিথিদের দেখতে না পেয়ে অবাক হয়ে যান যুধিষ্ঠির। কৃষ্ণের মুখে তখন সবজান্তা মুচকি মুচকি হাসি! তিনি যুধিষ্ঠিরকে আশ্বস্ত করেন এবং বলেন যে খাবারটি অসাধারণ ছিল। 


পাণ্ডবদের সঙ্গে পরবর্তীকালে আবার সাক্ষাৎ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নেন তিনি। যুধিষ্ঠিরের মন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। ধর্মের প্রতি অটুট বিশ্বাস এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অগাধ ভক্তি আবারও একবার প্রমাণ করল যে সবকিছু হারিয়ে নির্বাসনের যাতনা সহ্য করেও ন্যায়পরায়ণ জীবনযাপন করা সম্ভব।


উপসংহার:


এই কাহিনী আমাদের শেখায় যে, ভক্তির শক্তি এবং ঈশ্বরের কৃপা সংকটের মুহূর্তে কীভাবে রক্ষা করে। শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদে পান্ডবরা সেই বিপদ থেকে মুক্তি পান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please do not enter any spam link in the comment box.

Post Top Ad